জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে ঘিরে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ভোলার পাঁচটি কূপ খনন প্রকল্প। খরচ সাশ্রয়ী ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি আন্তর্জাতিক প্রস্তাব উপেক্ষা করে অভিজ্ঞতাহীন একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রায় ৮৪০ কোটি টাকার কাজ তুলে দেওয়ায় উঠেছে ১১২ কোটির বেশি টাকার অপচয় ও নীতিগত অনিয়মের অভিযোগ।
বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতিসম্পন্ন একটি তেল ও গ্যাস কোম্পানি বাপেক্সকে যৌথভাবে কূপ খননের প্রস্তাব দিয়েছিল। নিজস্ব রিগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে তারা কাজটি করতে চেয়েছিল ৭২৭ কোটি টাকায়। এতে কেবল বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয়ই হতো না, সময়ও কম লাগত এক বছরের মতো। সর্বোপরি, অংশীদারিত্বের এই সুযোগ বাপেক্সের নিজস্ব প্রযুক্তি ও সক্ষমতাও বাড়াত।
কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। খরচ বাঁচানোর সুযোগ উপেক্ষা করে বাপেক্স একটি ব্যয়বহুল দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনভিজ্ঞ একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার পথে হেঁটেছে। অভিযোগ উঠেছে, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (বর্তমানে পেট্রোবাংলার পরিচালক) মো. শোয়েব ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল প্রভাব খাটিয়ে আন্তর্জাতিক প্রস্তাবটি বাতিল করেছেন। এমনকি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও উপেক্ষিত হয়েছে।
নির্দেশনা অমান্য করে দরপত্র কার্যক্রম
মন্ত্রণালয় ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে এক অফিস আদেশে বলেছিল, কোনো প্রকল্পের ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল) অনুমোদনের আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা যেন কার্যক্রম শুরু না করে। অথচ তার আগেই দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করে বাপেক্স, যা সরকারি শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক নিয়মের পরিপন্থী।
দরপত্রে নির্বাচিত কোম্পানিটির অতীত রেকর্ডও প্রশ্নবিদ্ধ। সিলেট-১০ কূপ খননে তারা কাঙ্ক্ষিত গভীরতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ৩,৩০০ মিটার খননের লক্ষ্য থাকলেও, ২,৫৭৬ মিটারেই ড্রিল পাইপ আটকে যায়। এতে গ্যাস মজুত থাকা সত্ত্বেও উত্তোলন সম্ভব হয়নি। এখন সেখানে আবার ‘১০-এক্স’ নামে নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা করা হচ্ছে—যার পেছনে ব্যয় হচ্ছে আরও বিপুল অর্থ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোলার ভূগর্ভস্থ চাপ সিলেটের তুলনায় বেশি। ফলে সেখানে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের রিগ দিয়ে খনন শুরু করা বড় ধরনের ঝুঁকি। ব্যর্থতা ঘটলে শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, ভোলার গ্যাস মজুতও অপচয়ের শিকার হবে।
ভোলায় গ্যাসের সম্ভাবনা, কিন্তু ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি
এখন পর্যন্ত ভোলায় তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে—একই জেলার মধ্যে যা দেশের সর্বোচ্চ। চরফ্যাশন, হাতিয়া ও মনপুরা এলাকায় অনুসন্ধানে মেলে আশাব্যঞ্জক ফল। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, এই অঞ্চলে আনুমানিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস মজুত রয়েছে। দেশের দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহারে দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি।
কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। অভিজ্ঞ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে যখন অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের হাতে ব্যয়বহুল প্রকল্প তুলে দেওয়া হয়, তখন তা কেবল আর্থিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম ও জাতীয় স্বার্থেরও ক্ষতি করে।
তদন্ত দাবি সংশ্লিষ্টদের
জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট ও সাবেক কর্মকর্তারা মনে করছেন, অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকল্পটি পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি। একই সঙ্গে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, নির্দেশনা অমান্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসম্পদ ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে, সম্ভাবনা থাকলেও তা সুফল বয়ে আনবে না—উল্টো আস্থাহীনতা বাড়াবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি।