হাসিনা সরকারের বেপরোয়া হামলা আর গ্রেপ্তারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন তখন প্রায় নিভু-নিভু। এমন চরম সংকটময় মুহূর্তে ফিনিক্স পাখির মতো উড়ে আসে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। হাতে হাতে রেখে রাজপথে গড়ে তোলে সীসাঢালা প্রাচীর।
১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নারকীয় হামলা আর পুলিশী নির্যাতন। তবুও দমেনি ছাত্রসমাজ। বরং কোটাবিরোধী আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৭ জুলাই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ব্যাপক ধরপাকড়ে অনেকটাই স্থিমিত হয়ে পড়ে আন্দোলন।
প্রায় নিভে যাওয়া সেই আন্দোলন নতুন করে জাগিয়ে তোলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সবরকম ঝুঁকি নিয়ে নামেন রাজপথে।
১৮ জুলাই রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডাসহ গোটা প্রগতি স্মরণীতে শক্ত অবস্থান নেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পুলিশী হামলায় গোটা এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সংঘর্ষের ঝরে যায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর প্রাণ। একপর্যায়ে গুলি করতে-করতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ঢুকে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিই। মাত্র ২০ মিনিটেই প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী জড়ো হয়। আমরা সেখান থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
আরেকজন বলেন, পুলিশ আচমকা টিয়ারশেল ছুড়ে দিলে আমরা ক্যাম্পাসের তালাবদ্ধ গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকি এবং গেট বন্ধ করে দিই।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের হামলার খবর পেয়ে ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়ায়, ইস্টওয়েস্টসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের শক্ত প্রতিরোধে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় র্যাব পুলিশের সদস্যরা। কয়েকঘণ্টা পর তাদের উদ্ধার করা হয় হেলিকপ্টার দিয়ে।
ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই প্রতিরোধের মূল শক্তি হয়ে উঠে।
একজন নারী শিক্ষার্থী বলেন, আন্দোলনটা যখন নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছিল, তখনই ১৮ জুলাইয়ের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুভমেন্ট দিয়ে আবার সেটা জাগিয়ে তুলি।
আন্দোলনের সেই স্রোতে যোগ দিয়েছিল নর্থসাউথ, এআইইউবি, ইউআইইউ, নর্দান, কানাডিয়ান, ইউল্যাব, ড্যাফোডিল, স্টামফোর্ডসহ সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। তাদের শহিদদের তালিকায় অন্তত ৩০ জন।
তাদেরই একজন মারারাত বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষার্থী শাকিল পারভেজ। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ছিল যার ব্রত। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই বিভিন্ন রোগীকে রক্ত দিয়েছেন ১৮ বার। সেই আঠারো সংখ্যাটাই যেনো আবার ডেকেছিল তাকে। ১৮ জুলাই উত্তরার উত্তাল দিনে পুলিশের গুলিতে ঝরে যায় তার প্রাণ। সেই অপূরণীয় ক্ষতি তাড়িয়ে বেড়ায় শাকিলের বাবাকে।
শহিদ শাকিলের পিতা বলেন, ১৮ বার রক্ত দিয়েছিল ছেলেটা। ১৮ জুলাই সব রক্ত দিয়ে গেল জাতির জন্য। অনেক রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদ দূর হবে জানতাম, কিন্তু আমার ছেলের রক্ত দিতে হবে সেটা কখনো ভাবিনি।
জুলাইয়ের আগে-পরে কোনো কিছু পাওয়া না পাওয়ার হিসাবের খাতা খোলেননি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুধু গণঅভ্যুত্থানের পাতায় রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন আত্মত্যাগের ইতিহাস।






