ঢাকা | সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫,২৮ আশ্বিন ১৪৩২

পা দিয়ে লিখে বিসিএস পরীক্ষা দিলেন শারমিন

বেঞ্চে দুই পা তুলে ডান পা দিয়ে লেখেন শারমিন আক্তার। কলমে বেশ খানিকটা ভর দিয়ে, কিছুটা ধীরে লিখতে হয়। পা দিয়ে লিখেই আজ শুক্রবার ৪৯তম বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা দিলেন তিনি।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের শারমিন আজ পরীক্ষা দিয়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ কেন্দ্রে। সকাল ৯টার দিকে কলেজের সামনে বসেই কথা হলো শারমিনের সঙ্গে।

জন্ম থেকেই শারমিনের দুই হাত অকেজো। লিকলিকে দুটো হাত এবং বাঁকানো হাতের তালু থাকলেও তা দিয়ে কিছু ধরতে পারেন না তিনি। কোনো শক্তি নেই দুই হাতে। ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখেন হাত। চট করে দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না শারমিনের সমস্যা।

গতকাল বৃহস্পতিবার নোয়াখালী থেকে দুজন স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন শারমিন। ছিলেন সায়েদাবাদে অন্য এক স্বজনের বাসায়। আজ পরীক্ষা দিতে আসার সময়ও ওই দুই স্বজন সঙ্গে ছিলেন।

পরীক্ষার জন্য কেন্দ্রে ঢুকতে হবে, তাড়ার মধ্যেই শারমিন বললেন, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি ভালোই। তবে পরীক্ষায় টিকলেও তো চাকরি হয় না। কেউ ভাইভার (মৌখিক পরীক্ষা) জন্য ডাকে না। এর আগে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন, ভাইভার জন্য ডাকই পাননি। অন্যান্য জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। বয়সও থেমে নেই।

চাকরির আবেদন করি, পড়াশোনা করি, পরীক্ষা দিই, কোনো কোনোটাতে টিকেও যাই, কিন্তু পরে আর ডাকে না। এভাবেই চলছে আমার জীবন।

আজ পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে ফুটপাতে বসেই শারমিন যে পা দিয়ে লিখতে পারেন, তা দেখালেন। পা দিয়েই ফেসবুকেও স্ট্যাটাস লেখেন। সেখানে তিনি মনের যন্ত্রণার কথা লেখেন। ফেসবুকে সবার প্রতি আহ্বান জানান, তাঁকে একটি চাকরি বিশেষ করে একটি সরকারি চাকরি দেওয়ার জন্য।

অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে পড়াশোনা করে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী শারমিন আক্তার। এখন একটি সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। আজ শুক্রবার সকালে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের সামনে

শারমিন বলেন, ‘অন্যদের দুই হাত আছে, তা দেখে আমার কষ্ট হয়। মনে হয়, অন্যদের হাত আছে, আমার নেই কেন? বিষয়টি নিয়ে লজ্জাও পাই। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। মনে হয়, যার দুটি হাত নেই, তার জীবনে দুঃখ ছাড়া তো কিছু থাকতে পারে না। মাঝেমধ্যে মরে যাওয়ার কথাও ভাবি। চাকরির আবেদন করি, পড়াশোনা করি, পরীক্ষা দিই, কোনো কোনোটাতে টিকেও যাই, কিন্তু পরে আর ডাকে না। এভাবেই চলছে আমার জীবন।’

শারমিন জানালেন, ঢাকায় এসে চাকরির পরীক্ষা দিতে তাঁর কষ্ট হয়। একা আসতে পারেন না, সঙ্গে করে কাউকে না কাউকে আনতে হয়, এতে করে খরচটাও বেড়ে যায়। সরকার থেকে শারমিন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন, তিন মাস পরপর ২ হাজার ৫০০ টাকা। এ টাকা দিয়ে পড়াশোনা বা অন্য খরচ মেটান।

নোয়াখালী সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে ২০২২ সালে এমএ পাস করেছেন শারমিন। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা ফিরোজ আলম টুকটাক কৃষিকাজ করেন। নিজেদের সামান্য জমি আছে। মা বকুল বেগম গৃহিণী। পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে ভাইকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে বছর দুই আগে। এই ভাই এখন সংসারের হাল ধরেছেন। এক বোন ডিগ্রি পড়ছেন। শারমিন একটা চাকরি পেলে সংসারের হাল ধরতে পারবেন, সে আশায় দিন পার করছেন।

শারমিন জানালেন, ঢাকায় এসে চাকরির পরীক্ষা দিতে তাঁর কষ্ট হয়। একা আসতে পারেন না, সঙ্গে করে কাউকে না কাউকে আনতে হয়, এতে করে খরচটাও বেড়ে যায়। সরকার থেকে শারমিন প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন, তিন মাস পরপর ২ হাজার ৫০০ টাকা। এ টাকা দিয়ে পড়াশোনা বা অন্য খরচ মেটান।

আজ পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে ফুটপাতে বসেই শারমিন যে পা দিয়ে লিখতে পারেন, তা দেখালেন। পা দিয়েই ফেসবুকেও স্ট্যাটাস লেখেন। সেখানে তিনি মনের যন্ত্রণার কথা লেখেন। ফেসবুকে সবার প্রতি আহ্বান জানান, তাঁকে একটি চাকরি বিশেষ করে একটি সরকারি চাকরি দেওয়ার জন্য।

শারমিনের দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করেন তাঁর মা। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও শারমিন পিএইচডি করতে চান। সরকারি চাকরি করতে চান। তাঁর ভাষায় ‘সরকারি অফিসার’ হতে চান।

শারমিন বিশেষ বিসিএসে প্রতিবন্ধী কোটায় আবেদন করেছেন। পরীক্ষা শেষে জানালেন, আজকের (এমসিকিউ) পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই দিয়েছেন। তবে চাকরি পাবেন, সে নিশ্চয়তা তো নেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সরকারি চাকরিতে ঢোকার জন্য বয়সসীমা ৩২ বছর, সে হিসেবে শারমিনের হাতে খুব বেশি সময় নেই, হাতে আছে মাত্র দেড় বছরের মতো।

আজ দুপুরে পরীক্ষা শেষ হতে হতে বৃষ্টির মধ্যে পড়েন শারমিন। বৃষ্টি মাথায় করে বাসে চেপে নোয়াখালীর পথে রওনা হন। বাসে বসে ফোন করে বললেন, ‘আমি একটি সরকারি চাকরি চাই।’

খবর প্রথম আলো।